বিএনপি নেতা মির্জা জাফরের সাম্প্রতিক মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ এন টিভির একটি টক শোতে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্যের মন্তব্যে আমরা অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছি। আমাদের বলতে হচ্ছে, আপনাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণেই আমাদের মতো অনুজদের রাস্তায় নেমে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আপনারা দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিয়ে রাস্তায় নামাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই আমাদের অনুজদের সেই ভূমিকা নিতে হয়েছে। এখন যদি মনে করেন, এসব ‘পিচ্চি’ কোথা থেকে এসে এমন বক্তব্য দিচ্ছে, তাহলে আমাদের কষ্ট হয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমার নিজেরও রক্ত ঝরেছে। আমি এই রক্ত কাউকে ক্ষমতায় আনার জন্য দেইনি, বরং রাষ্ট্রের পুনর্গঠন ও সংস্কারের জন্য দিয়েছি। বিএনপিকে বলতে চাই, আপনাদের দলের যে কর্মী জীবন দিয়েছেন, তিনি কি কেবল তার এলাকার কাউকে এমপি করার জন্য জীবন দিয়েছিলেন? আপনারা বলছেন গণতন্ত্র হুমকির মুখে, কিন্তু গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলে যাদের উৎখাত করেছি, তাদের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা আমরা বলছি। অথচ এখানেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। বারবার নির্বাচন দ্রুত করার দাবি সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে, যদিও আমরা কখনো বলিনি যে নির্বাচন হবে না। কিন্তু প্রতিটি বিষয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করছি, তবুও এত তাড়াহুড়া কেন?”
তিনি উল্লেখ করেন, “২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন নির্বাচনের মাধ্যমে, এরপর কি হয়েছে? সাংবিধানিক সংকটের কথা বলা হচ্ছে চুপুকে সরানোর প্রসঙ্গে। ২০১৪ সালে বলেছিলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক সংকট হবে। তাই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আমাদের প্রয়োজন। বিএনপির বক্তব্যকে একই সূত্রে গাঁথা দেখছি, যেখানে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য সংকটের অজুহাত দেখিয়েছেন এবং চুপুকে ক্ষমতায় রাখতে সাংবিধানিক সংকটের কথা বলা হচ্ছে।”
আব্দুল হান্নান মাসুদ আরও বলেন, “বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ যদি সংস্কার ছাড়াই নির্বাচনে যায় এবং যদি কেউ বাধা দেয়, আমি সেই বাধা প্রদানে প্রথম হবো। আমি রাজপথে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছি সংস্কারের জন্য, ক্ষমতার লোভে নয়। আমাদের গঠিত কমিশনগুলো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে রিপোর্ট দেবে তিন মাসের মধ্যে। এই রিপোর্টের আলোকে কি কি সংস্কার প্রয়োজন, তা নির্ধারণ হবে এবং সেই সংস্কারের সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র বিএনপি তাড়াতাড়ি নির্বাচনের দাবি করছে।”
তিনি বলেন, “জনতার বিরুদ্ধাচরণ করে কখনো কেউ টেকেনি। বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে কি ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। জনগণের কাছে তারা স্পষ্ট করুক যে নির্বাচনের জন্য কি কি সংস্কার প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো ফ্যাসিস্ট শাসনের ঝুঁকি না থাকে।”
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আপনারা অনেক প্রোগ্রাম দিয়েছেন, কিন্তু এ দেশের মানুষের সমর্থন পেতে পারেননি। আমরা আপনাদের সাথে পরামর্শ না করেই প্রোগ্রাম দিয়েছি এবং জনগণ তা গ্রহণ করেছে। রাজনীতি করার জন্য বয়স কোনো বাধা নয়। ৭০ বছর বয়সে কেউ শিখতে পারেন আবার কেউ ১৫ বছর বয়সে পরিণত রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠতে পারে। আমরা কোনো প্রজন্মকে অবজ্ঞা করছি না; ১৬ বছর ধরে যে সংগ্রাম চলছে, তার ইতি হয়েছে ছাত্রদের হাত ধরে। সেই ছাত্রদের অবজ্ঞা করে কথা বলা অনুচিত।”
তিনি সংবিধান সংশোধনের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, “যে সংবিধান নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘মুজিবের তৈরি করা এই সংবিধান আস্থা করে ফেলে দিতে হবে।’ অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারকে যদি আপনি শেখ হাসিনার মতো জনগণের সরকার বলে আখ্যায়িত করতে চান, তাহলে গণঅভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। ২০১৩ সালে বেগম জিয়া এই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলার কথা বলেছিলেন। নতুন সংবিধান গঠিত হবে কি হবে না সে বিষয়ে বিএনপির বক্তব্য দরকার।”
তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা সংবিধানকে কেটে তার চরিত্রই বদলে দিয়েছেন। সেই সংবিধানের এত মায়া কেন? চুপ্পু যখন রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা তখনই বলেছিল যে চুপ্পু একজন আসামি ছিলেন। অথচ এখন তাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য এত দরদ কেন?”
মাসুদ বলেন, “তারা বলছেন চুপ্পুকে সরালে সাংবিধানিক সংকট হবে। কিন্তু জনগণের সামনে সেটা স্পষ্ট করুন যে, কিভাবে সংকট তৈরি হবে। শেখ হাসিনার ভাষায় কথা বলার দরকার নেই। গণঅভ্যুত্থানে নেতাদের সম্মান দেয়া হচ্ছেনা, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে দেশে থাকতে পারবো কিনা সন্দেহ। আমাদের প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।”
বিএনপির নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনারা আমাদের মুরুব্বী, আমাদের দিকনির্দেশনা দিন। দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের জন্য পরামর্শ দিন। এখন পর্যন্ত কোনো পরামর্শ পাইনি; কেবল মিডিয়াতে বক্তব্য দিচ্ছেন। আমাদের প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনায় ডাকুন এবং আলোচনা করুন। প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে আমাদের ব্যাখ্যা দিন। শেখ হাসিনার শাসনের ট্রমা থেকে এখনো আমরা বের হতে পারিনি।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “গতকাল চাঁদপুরে একজন সমন্বয়কারীকে মারধর করা হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে না নেওয়ার কারণে। চাঁদপুর কলেজের একজন অধ্যক্ষ ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, এবং তার পদত্যাগ চাওয়ার কারণেই বিএনপির কর্মীরা ছাত্রদের মারধর করেছে। এই দ্বন্দ্বের কোনো মানে হয় না।”
তার শেষ কথায়, “৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর যে প্রস্তাবনা ছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি। একই ফাঁদে আমরা আর পা দিতে চাই না। বিএনপির ৩১ দফা প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হোক।
সমন্বয়ক হাস্নাত আব্দুল্লাহ মির্জা আব্বাসের বাপের আগে সন্তান গেলে দেশ শেষ হয়ে যাবে এমন বক্তব্যের প্রতবাদ করে বলেন, বিএনপি নেতার মতে তরুণরা দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ তারাই দেশের ভবিষ্যতের নেতৃত্ব। তিনি বলেন, মির্জা আব্বাসের রাজনীতি করার বয়স আমার বাবার বয়সের চেয়েও বেশী। ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনে তাদের অবদান তাত্পর্যপূর্ণ। মির্জা আব্বাসের প্রতি সম্মনা জানিয়ে তিন বলেন, প্রজন্মের মধ্যে এই ধরনের কনফ্লিক্ট সৃষ্টি না করে সংস্কারের পথে এগিয়ে আসতে হবে।”