মুহাম্মদ শাহ্ আলম ভূঁইয়া। 

বাংলাদেশের মানুষের নিকট একটা কমন শব্দ সিন্ডিকেট বানিজ্য। পতিত স্বৈরাচার জাতিকে এই সিন্ডিকেটের কবলে ফেলে একদম নিষ্পেষিত করে ফেলে ছিল।
আহা! বেচারা জাতি উহু-আহা করার মত ক্ষমতা ও হারিয়ে ফেলেছিল।

সিন্ডিকেটের এই বানিজ্যের থাবা কতটুকু বিস্তার লাভ করেছিল একে একে আমরা একটু দেখে নিই।

১। দ্রব্য মূল্যে : দ্রব্যমূল্যের এই সিন্ডিকেট পুরো জাতির জীবনকে চরমভাবে নি:ষ্পেশিত করে দিয়েছে। চাল,ডাল,তেল,লবন,পেঁয়াজ,আলু,ডিম থেকে শুরু করে কাঁচা তরিতরকারি এবং সব্জির মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায় বিগত পনের বছরে। যার ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান। এর কারন কি?

এর কারন হচ্ছে যাহা আওয়ামিলীগ তাহাই বিএনপি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি হচ্ছে মুদ্রার এপিট- ওপিট। বিগত পনের বছর যাহা আওয়ামিলীগ এর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল বর্তমানে তাহা বিএনপির নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে অথবা হওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

২। শেয়ার বাজার : দরবেশ বাবার নেতৃত্বে শেয়ার বাজারের হরিলুট সাধারণ বিনিয়োগ কারীদের জীবনে একমহা দূর্যোগের ঘনঘটা নেমে আসে।অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী তার জীবনের উপার্জিত সমস্ত কিছু এই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে একেবারে পথে বসে গেছে। এমনকি কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেচে নিয়েছে। যার কারনে কোন কোন পরিবার পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর কোন প্রতিকার ছিল না। অবশ্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা স্ব-হস্তে জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে এর প্রতিকার – প্রতিশোধ নিয়েছেন। সফেদ দাড়ির এই সালমান এফ রহমান এর মত দরবেশের গোঁফ – দাড়ি বিহিন গ্রেফতারের সেই দৃশ্য আমাদের জন্য কি কোন শিক্ষার অবতারণা করেছে? এই হাজার হাজার কোটি টাকার কি দাম? তাদের কাছে হয়তবা এটাই জীবন। কারন প্রবাদ আছে “চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। “

৩। হজ্জ এবং টিকেটিং : এই সেক্টর গুলোতে ও দরবেশ বাবা তার থাবা বিস্তার করেছিল। মানুষ রুপি এই দানব গুলো কি রকম অমানুষ ছিল একটা লোক তার জীবনের শেষ সম্বল টুকু দিয়া তার জীবনের একটা ফরজ কাজ পালন করবে। কিন্তু এই দালালদের সিন্ডিকেট বানিজ্যের কারনে অনেকের পক্ষে তা পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সরকার অবশ্য এক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যা হজ্জ যাত্রী দের মাঝে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এনেছে।

টিকেটিং এর ক্ষেত্রে এই দানব গোস্টি এমন ভাবে ট্যাক্স আরোপ এবং আরও কিছু কার্যক্রম করেছে যে টিকেটের দাম চার পাঁচ গুণ বেড়ে গিয়েছে। যে টিকেট আমরা দুবাই-ওমান পঁচিশ – ত্রিশ হাজার টাকায় আপ-ডাউন ভ্রমণ করতাম সে টিকেট প্রায় নব্বই হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত প্রাইস হয়ে যায়। জালেমের পক্ষ থেকে সমগ্র জাতীর উপর কি সীমাহীন জুলুম?

৪।ব্যাংকিং সেক্টর : ব্যাংকিং সেক্টরের কথা আর কি বলব? আট টি ইসলামি ব্যাংক এস আলম তার কব্জায় নিয়ে বিশেষ করে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি কে কিভাবে দানবীয় কায়দায় সরকারি গোয়েন্দা বাহিনী ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে রাতের আঁধারে দখল করে নিয়েছে তা এখন সকলের ই জানা।
ইসলামী ব্যাংকের প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা নামে বেনামে এস আলম বিদেশে পাচার করেছে। যে টাকার ভাগ বড় আপা, চোট আপা,ডিজিএফআই,দূদক , ডিবি, বিচার পতি সহ সকলের নিকট যেত।
দেশের অর্থনীতির প্রায় তেত্রিশ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকারী ব্য্যাংকটিকে আজ পংগু করে দেওয়া হয়েছে।
একটা সময় ব্যাংক টি হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছিল না অথচ এখন সেই ব্যাংকটি আজ লিকুইডিটি সমস্যায় ভুগছে। গ্রাহকদের চেক পাস করাতে সমস্যা হচ্ছে। শত শত ব্যাবসায়ী আজ ডিফল্ট ক্লায়েন্ট হিসেবে পথে বসে গেছে।

নাসা গ্রুপ এর নজরুল ব্যাংকিং সেক্টরের আর এক দানব। যে সরাসরি চাঁদাবাজি করে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়া প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে দান করত এবং নিজের উদর ভর্তি করত।

৫।এফবিসিসিআই এবং বিজিএমইএ সিন্ডিকেট : এফবিসিসিআই এবং বিজিএমইএ সহ ব্যাবসায়ী ফোরামের সকল সেক্টর পতিত স্বৈরাচারের সিন্ডিকেটের কবলে আপতিত ছিল। এই সমস্ত বিজনিস ফোরাম গুলো এক সময় বিপুল উতসাহ – উদ্দীপনা সহ নির্বাচন হত। কিন্তু পতিত স্বৈরাচার এর কবলে পড়ে এই সমস্ত সকল বিজনিস ফোরাম তার স্বাতন্ত্র্য বোধ হারিয়ে ফেলেছিল। ইলেকশানের পরিবর্তে সিলেকশনের মাধ্যমে তারা সকল নেতা নির্বাচিত করত। যারা কারখানার মালিক নয় তাদেরকে বিজিএমইএ র সদস্য বানিয়ে এস এম মান্নান কচি ভূয়া ভোটের মাধ্যমে বিজিএমইএ দখল করেছে। সে বিজিএমইএ এর সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হয়ে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছে।

বৈষম্য বিরোধী ছাএ-জনতার আন্দোলনের সময় মিরপুর ১০ নং এবং উত্তরা তে তার নেতৃত্ব সরাসরি গুলি চালিয়ে অনেক ছাত্র জনতা কে শহীদ করে দিয়েছে। আজ সে শেখ হাসিনার সাথে খুনের মামলার আসামী হিসেবে ফেরারি জীবন যাপন করছে।

৬।কাস্টমস হাউজ এ সিন্ডিকেট এর দাপট এবং কর বৈষম্যের অবসান : চট্রগ্রাম, মংলা বেনাপোল, ভোমরা এবং ভূরিমারি থেকে শুরু করে আখাউড়া, বিলোনিয়া সকল কাস্টমস হাউজ আওয়ামী সিন্ডিকেট এর একক নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই জালিয়াত চক্র অনেক সময় সি এন্ড এফ এর সহযোগিতায় ফুড আইটেম কে নন ফুড অর্থাৎ ট্যাক্স এর আইটেম কে নন ট্যাক্স আইটেম বানিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এই ক্ষেএে ট্যাক্স বৈষম্য স্মল ইম্পোর্টারদের ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে চরম নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করেছে। অনেক ছোট ব্যবসায়ী গন তাদের সকল পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছেন।
অথচ সিন্ডিকেট ব্যাবসায়ীরা তাদের ব্যবসা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের টোটাল আমদানি এখন সাত আটজন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। পুরো জাহাজ ভর্তি করে তারা মালামাল নিয়া আসিতেছে। এখানে স্মল ব্যবসায়ী গন টিকে থাকতে পারছে না।
পুরে ব্যাবসা এখন এস আলম, মেঘনা, বসুন্ধরা, সিটি গ্রুপ, মদিনা গ্রুপ সহ এই সমস্ত সিন্ডিকেট এর নিয়ন্ত্রণে।

এই ক্ষেত্রে ট্যাক্স নির্ধারণে স্বৈরাচারী সরকার অনেক বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে। পৃথিবীর কোথাও এত অধিক হারে ট্যাক্স আরোপ নাই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৫% ট্যাক্স দিয়া মানুষ ব্যবসা করিতেছে। সেখানে আমাদেরকে বাচ্চাদের আইটেম, চকলেট, বিস্কুট সহ খাওয়ার আইটেম, ফল, খেজুর এর উপর ১৩০% ১৫০% পর্যন্ত ট্যাক্স আরোপ করে রেখেছে।
বিশেষ করে খেজুর মানুষের রমজানের একটা অত্যাবশকীয় উপাদান।
সেই খেজুর আমরা কোন এক সময় যেখানে দশ লাখ টাকা ট্যাক্স দিতাম এখন সেখানে সেই সমপরিমাণ খেজুরের ট্যাক্স দিতে হয় ৫০.০০ লাখ টাকা।

এই সমস্ত ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে ট্যাক্স বৈষম্যের অবসান করা খুবই জরুরী। বিশেষ করে সামনে রমজানুল মোবারক।এই রমজান উপলক্ষে খেজুরের ট্যাক্স পূন:নির্ধারণ খুবই জরুরী।

সিন্ডিকেট ভাংগার ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে দ্রব্য মূল্যের নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে দেশপ্রেমিক, সত জনগন যাদের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক আছে তাদের হাতে সরকারি ভাবে টিসিবির মত সিস্টেম চালু করে ভোগ্যপণ্যের সিন্ডিকেট ভাংগার উদ্যোগে গ্রহন করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই বর্তমান নির্দলীয় সরকারের উপর জাতির প্রত্যাশা অনেক বেশী। তাই এই সরকার যেহেতু নির্দলীয় তাদের পক্ষেই জাতীর ঘাড়ে চেপে বসা এই দূর্বৃত্তায়নের সিন্ডিকেট ভেংগে দেওয়া সম্ভব। এই ক্ষেএে পূরাতন সিন্ডিকেট ভাংতে হবে এবং নূতন করে যারা এই সিন্ডিকেটের অংশীজন হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহন করিতেছে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। তাহলেই জুলাই বিপ্লব ২০২৪ এর সুফল জনগনের নিকট পৌঁছবে বলে আশা করা যায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা মজলুম জনতার সেই প্রত্যাশা পূরনের তওফিক দিন।

লেখক : বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং সাবেক ছাত্র নেতা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে