ঢাকা, ডিসেম্বর ১, ২০২৪ – মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) তাদের নভেম্বর মাসের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এক ভীতিকর চিত্র প্রকাশ করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও সার্বিক অগ্রগতির লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি। নভেম্বর মাসজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, সাংবাদিকদের হয়রানি এবং নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি গভীর সংকটের দিকে ইঙ্গিত করছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, নভেম্বর মাসে দেশে ১০৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে অন্তত ১৬ জন নিহত এবং ৫৯৯ জন আহত হয়েছেন। বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই ৫১টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১০ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া বিএনপি-আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সংঘর্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও ২৫৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে, যার মধ্যে ২১৪টি হত্যা মামলা। এ সময় অন্তত ৪৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বিষয়টি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। চট্টগ্রামে ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তি দাবিতে সংঘর্ষে একজন আইনজীবী নিহত হন এবং ২৫ জন আহত হন। এই ঘটনা দেশের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার একটি উদাহরণ। সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলা, মন্দির ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য।
সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণও চলমান রয়েছে। এইচআরএসএস জানিয়েছে, নভেম্বর মাসে ৪৬ জন সাংবাদিক নির্যাতন এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৭ জন, লাঞ্ছিত হয়েছেন ৯ জন, এবং গ্রেফতার হয়েছেন ৫ জন। দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার পত্রিকা বন্ধের দাবিতে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভ এবং ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনে জানানো হয়, এ মাসে ১১০ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩২ জন, যার মধ্যে ১৭ জন শিশু। গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে। পারিবারিক সহিংসতায় ৩১ জন নারী নিহত হয়েছেন এবং আত্মহত্যা করেছেন আরও ১৫ জন। শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১০৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ৪৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
সীমান্তে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বিএসএফের হামলায় তিনটি ঘটনায় চারজন আহত এবং ছয়জন গ্রেফতার হয়েছেন। বিজিপির হামলায় এক বাংলাদেশি নিহত এবং ২৬ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
গণপিটুনির ঘটনাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এইচআরএসএস জানায়, নভেম্বর মাসে ২১টি গণপিটুনির ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং ১৫ জন আহত হয়েছেন। শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনাও কমেনি। এ মাসে ৩৬টি ঘটনায় ২৬ জন শ্রমিক নিহত এবং ২৩ জন আহত হয়েছেন।
এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এইচআরএসএস। তারা মনে করে, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য প্রশাসনের আরও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে।