ঢাকা, ৫ মার্চ ২০২৫:

বাংলাদেশে গণপিটুনির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে গত ১০ বছরে অন্তত ১০০৯টি ঘটনায় ৭৯২ জন নিহত ও ৭৬৫ জন আহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

গণপিটুনির পরিসংখ্যান:

এইচআরএসএস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণপিটুনির ঘটনা ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাচ্ছে না। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে,

বছরঘটনানিহতআহত
২০১৫৮৯১২৮৯৫
২০১৬১১১১০৪৪১
২০১৭৮৫৬৫৮৫
২০১৮৭৪৪৪৬৪
২০১৯১১২৭৩১০৩
২০২০৬১৪০৩০
২০২১৮৩৪৮৮৫
২০২২৭৯৩৮৮৩
২০২৩১১৪৭৩৯১
২০২৪২০১১৭৯৮৮
মোট১০০৯৭৯২৭৬৫

২০২৪ সালে ২০১টি ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হন, যা বিগত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সাম্প্রতিক ভয়াবহ ঘটনাগুলো:

গণমাধ্যম ও এইচআরএসএস-এর তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক কয়েকটি আলোচিত গণপিটুনির ঘটনা হলো:

  • ৩ মার্চ ২০২৫: চট্টগ্রামের এওচিয়া ইউনিয়নে মাইকে ‘ডাকাত’ ঘোষণা দিয়ে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা।
  • ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: মাদারীপুরে ডাকাতির ঘটনায় শরীয়তপুরে ৭ জন ডাকাতকে গণপিটুনিতে ৫ জন নিহত।
  • ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: উত্তরা এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা।
  • ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪: গুলিস্তানে ছিনতাইকারী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা।
  • ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা।
  • ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক যুবককে হত্যা।
  • ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে গণপিটুনিতে হত্যা।

কেন বাড়ছে গণপিটুনির ঘটনা?

এইচআরএসএস-এর মতে, গণপিটুনির অন্যতম কারণ হলো:

  1. আইনের প্রতি অনাস্থা: জনগণের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা কার্যকর নয়, ফলে তারা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।
  2. বিচারহীনতার সংস্কৃতি: অধিকাংশ গণপিটুনির ঘটনায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
  3. ভুয়া তথ্য ও গুজব: অনেক সময় ডাকাত, ছেলেধরা, ধর্মীয় অবমাননার মতো অভিযোগ ছড়িয়ে গণপিটুনির ঘটনা ঘটে।
  4. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা: পুলিশের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও কখনো কখনো তারা সময়মতো ব্যবস্থা নেয় না।

আইনি দিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিক আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকারী। সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।

এছাড়া, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ অপরাধী হিসেবে ধরা পড়ে, তবে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। গণপিটুনিতে কেউ নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী এতে অংশ নেওয়া প্রত্যেকেই সমানভাবে দায়ী হবে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে, ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার ঘোষণার ৩ ও ৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতিটি ব্যক্তির জীবন ও নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে এবং কোনো ব্যক্তির প্রতি নির্যাতন, অমানবিক আচরণ করা যাবে না।

এইচআরএসএস-এর দাবি ও সুপারিশ

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জনগণের প্রতি আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে এবং সরকারের কাছে নিম্নলিখিত দাবিগুলো জানিয়েছে:

  1. সচেতনতামূলক কার্যক্রম: গণপিটুনির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রচারণা চালানো।
  2. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ: পুলিশ ও প্রশাসনকে কঠোরভাবে গণপিটুনির ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করতে হবে।
  3. বিচার নিশ্চিত করা: গণপিটুনিতে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
  4. গুজব প্রতিরোধ: সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যা তথ্য ও গুজব বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।

গণপিটুনি শুধুমাত্র ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায় না, বরং এটি দেশের আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতাকে সামনে নিয়ে আসে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে দেশে আর কোনো নিরীহ মানুষ গণপিটুনির শিকার না হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে