২৬ আষাঢ়, ১৪৩২, ১০ জুলাই, ২০২৫, ১৪ মহর্‌রম, ১৪৪৭

মানুষের জ্ঞানের সীমানা ছাড়িয়ে এক মহাপুরুষের অন্তর্দৃষ্টি

– ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)-এর বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞা

কামাল সিকদার

ইতিহাসের অমলিন পৃষ্ঠায় হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.)-এর নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে। তিনি ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাতো ভাই, জামাতা এবং তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী। ছোটবেলা থেকেই রাসূল (সা.) তাঁকে নিজের স্নেহে লালন-পালন করেছেন। রাসূল (সা.) আলী (রা.)-কে শুধু ভালোবাসতেন না, তাঁকে নিজের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী করে তুলেছিলেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, “আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা।” এই ঘোষণা শুধু ভালোবাসার নয়, ছিল আলীর জ্ঞানের প্রতি রাসূলের গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের পরিচায়ক।

হযরত আলী (রা.)-এর প্রতি রাসূল (সা.)-এর ভালবাসা ও আস্থা ছিল অপরিসীম। রাসূল (সা.) একবার বলেছিলেন, “আমার এবং আলীর সম্পর্ক মুসা (আ.) ও হারুন (আ.)-এর মতো, তবে আমার পর আর কোনো নবী আসবে না।” রাসূল (সা.)-এর জীবনসংগ্রামে আলী (রা.) ছিলেন নির্ভরতার প্রতীক। হিজরতের রাতে, যখন কুরাইশরা রাসূল (সা.)-এর প্রাণ নিতে প্রস্তুত, তখন আলী (রা.) নির্ভয়ে রাসূলের বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন। বদর, উহুদ ও খন্দকের ময়দানে তাঁর তরবারির ঝিলিক কাফেরদের হৃদয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয় তাঁর সীমাহীন প্রজ্ঞা।

খিলাফতের সময় আলী (রা.) নিরবিচারে যুদ্ধের মুখোমুখি হন। বিভিন্ন বিদ্রোহ, বিভক্তি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও তিনি জ্ঞানচর্চা থেকে সরে আসেননি। তাঁর বাণী, বক্তৃতা ও চিঠির সংকলন ‘নাহজুল বালাগা’ আজও মানবতার জন্য এক অমূল্য সম্পদ। যদিও কেউ কেউ এর প্রামাণিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তবে যারা তাঁর ভাষার গভীরতা বুঝতে পারে, তারা নিঃসন্দেহে জানে—এ যেন এক জ্ঞানের সাগর।

একবার কুফায় এক ব্যক্তি তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে তাঁকে অপমান করতে এসেছিল। আলী (রা.) তখন নামাজের প্রস্তুতিতে ছিলেন। নানা ফন্দি ফিকির করতো সে কিভাবে আলী (রাঃ) কে কষ্ট দেয়া যায়। একবার সে আসরের নামাজের সময় আলী (রাঃ) ধরলো। খলিফার স্বভাব ছিলো কেউ কিছু জানতে চাইলে তাকে সন্তোষ না করে অন্য কোন কাজ তিনি করতেন না। ধূর্ত এই লোকটি সেটা জানতো। তাই সে জানতে চাইল, “বলুন তো, কোন প্রাণী ডিম পাড়ে, আর কোন প্রাণী বাচ্চা দেয়?” উদ্দেশ্য ছিল আলী (রা.)-এর মনোযোগ বিভ্রান্ত করা এবং নামাজে দেরি করিয়ে তাঁকে বিরক্ত করা। ঐ ব্যাক্তির ধারণা ছিলো দুনিয়ার সব প্রাণীর নাম করতে করতে তার নামাজ কাজা হবে এবং এর ফলে আলী অসম্ভব মনোকষ্ট পাবেন। কিন্তু আলী (রা.) অতি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, “যার কান বাইরের দিকে, সে বাচ্চা দেয়। যার কান ভিতরে, সে ডিম পাড়ে।” উত্তর দিয়ে তিনি নির্বিঘ্নে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। লোকটা হতবাক আর আরবী ভাষায় জবাবটা ছিলো আরো সংক্ষীপ্ত।

পড়ুনঃ  মহাবিশ্বের ‘মৃত্যুর দিন’ জানিয়ে দিলেন বিজ্ঞানীরা — পৃথিবীর জন্য সময় যেন এখন উল্টো দিকে চলছে

আশ্চর্যের বিষয়, আজকের আধুনিক বিজ্ঞানও আলী (রা.)-এর এই বক্তব্যের সঠিকতা প্রমাণ করে। স্তন্যপায়ীদের কান বাইরের দিকে এবং তারা বাচ্চা জন্ম দেয়। পাখি ও সরীসৃপদের কান শরীরের অভ্যন্তরে এবং তারা ডিম পাড়ে। তখনকার দিনে এমন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়।

আরেকদিন কুফার মসজিদে এক ব্যক্তি আলী (রা.)-কে প্রশ্ন করল, “পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত?” আলী (রা.) হেসে বললেন, “একটি আরবী ঘোড়া যদি ছুটতে ছুটতে ৫০০ বছর অতিক্রম করে, তবে সে সূর্যে পৌঁছাবে।” এই কথাটি নিছক কল্পনা নয়। আরবী ঘোড়ার গড় গতি ঘণ্টায় ২২ মাইল। যদি এটি দিনে ২০ ঘণ্টা ছুটে চলে, তবে দিনে ৪৪০ মাইল, বছরে ১,৫৫,৭৬০ মাইল এবং ৫০০ বছরে এটি প্রায় ৭৭.৮ মিলিয়ন মাইল অতিক্রম করবে। আধুনিক বিজ্ঞানের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব প্রায় ৯৩ মিলিয়ন মাইল। এই তুলনায় আলী (রা.)-এর অনুমান বিস্ময়করভাবে সঠিক।

আলী (রা.) একবার আকাশের তারাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “আকাশের তারাগুলো পৃথিবীর শহরের মতো। প্রতিটি তারা আরেকটি তারার সঙ্গে আলোর স্তম্ভে যুক্ত।” তাঁর এই বর্ণনা আজকের গ্যালাক্সির সংজ্ঞার সঙ্গে মিলে যায়। আজ আমরা জানি, মহাবিশ্বের বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জ ও গ্যালাক্সিগুলো আলোক-ফিলামেন্টের মাধ্যমে যুক্ত। তাঁর এই উপমা শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, এক অসাধারণ কাব্যিক সৌন্দর্যও বহন করে।

আলী (রা.)-এর ভাষাগত দক্ষতাও ছিল অতুলনীয়। একবার আরবদের মাঝে বিতর্ক হয়েছিল, কোন অক্ষর আরবিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। তারা সিদ্ধান্তে এসেছিল—‘আলিফ’। আলী (রা.) তখন দাঁড়িয়ে এমন একটি দীর্ঘ খুতবা দেন, যেখানে ‘আলিফ’ অক্ষরটি একবারও ব্যবহার করা হয়নি। পরে তিনি আরেকটি খুতবা দেন যেখানে কোনো বিন্দুযুক্ত অক্ষর ছিল না। তাঁর এই অসাধারণ ভাষা-নৈপুণ্য আজও সাহিত্যিকদের বিস্মিত করে।

আলী (রা.) বলেন, “ এমন কিছু রঙ আছে যা মানুষের চোখ দেখতে পায় না এবং তাদের চারপাশে এমন প্রাণী আছে যাদের তারা দেখতে পারে না।” আজ আমরা জানি, অতিবেগুনি এবং অবলোহিত আলো মানুষের চোখে দেখা যায় না। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুজীবের অস্তিত্ব তখনও মানুষ জানত না। অথচ আলী (রা.) সে সময়েই এসবের কথা বলেছিলেন।

পড়ুনঃ  The scientific understanding of Ali, 4th Caliph of Islam

শব্দের ব্যাখ্যায় আলী (রা.) বলেন, “আল্লাহ ছাড়া কেউ অতিক্ষীণ শব্দ শুনতে পারে না, অতিরিক্ত শব্দ মানুষকে বধির করে দেয় এবং দূরের শব্দ মানুষের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।” আধুনিক বিজ্ঞান এখন জানে, ইনফ্রাসোনিক শব্দ মানুষের শ্রবণসীমার নিচে, অতিরিক্ত শব্দ শ্রবণশক্তি নষ্ট করে, এবং মহাকাশের অনেক শব্দ আমাদের শ্রবণে পৌঁছায় না।

মানব আচরণের ব্যাখ্যায় আলী (রা.) বলেছিলেন, “পিতা-মাতার ভালোবাসা সন্তানদের মিলিত করে, আর তাদের ঘৃণা সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করে।” আজ বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, ফেরোমোন নামক রাসায়নিক পদার্থ মানব আচরণ ও মনোভাবের উপর প্রভাব ফেলে। আলী (রা.)-এর বক্তব্য ছিল সেই গভীর বাস্তবতার প্রতিফলন।

নৌচালনার ক্ষেত্রে আলী (রা.) বলেছিলেন, “নক্ষত্রের সাহায্যে দিক নির্ধারণ করা যায়।” আজও নাবিকেরা ধ্রুবতারার সাহায্যে সমুদ্রপথ নির্ধারণ করে থাকে। তাঁর জ্ঞানের ব্যাপ্তি ছিল এমনই—পৃথিবীর সকল প্রান্ত ছুঁয়ে যায়।

একদিন এক ব্যক্তি দীর্ঘ পথ পেরিয়ে কুফায় এসে আলী (রা.)-কে কিছু দার্শনিক প্রশ্ন করলেন। তিনি জানতে চাইলেন—আল্লাহ প্রথম কী সৃষ্টি করেছেন? আলী (রা.) বললেন, “আলো।” এরপর তিনি বললেন, “সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী দশটি বিষয় হলো: পাথর, লোহা, আগুন, পানি, মেঘ, বাতাস, বাতাসের ফেরেশতা, মালাকুল মাওত, মৃত্যু এবং সর্বোপরি আল্লাহর আদেশ।”

আলী (রা.)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আকাশের প্রথম স্তর জলীয় বাষ্প দিয়ে তৈরি, দ্বিতীয় স্তর তামার মতো, তৃতীয় স্তর লালচে, চতুর্থ স্তর রূপার মতো, পঞ্চম স্তর রূপালি, ষষ্ঠ স্তর পান্নার মতো এবং সপ্তম স্তর মুক্তার মতো সাদা। আকাশের তালা হলো শিরক এবং চাবি হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপত্যকা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন সেরেনদ্বীপ, আজকের শ্রীলঙ্কা, যেখানে ধারণা করা হয়, হযরত আদম (আ.) পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন। আর পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর উপত্যকা হিসেবে উল্লেখ করেন বাহরুত (ইয়েমেন), যা অবিশ্বাসীদের আত্মার শাস্তির স্থান।

আলী (রা.) আরও বলেছিলেন, জান্নাতে মানুষ খাবে, কিন্তু সেখানে শরীরের চাহিদা থাকবে না। ঠিক যেমন গর্ভে শিশু খায়, কিন্তু মলত্যাগ করে না। তাঁর এই তুলনা ছিল অপূর্ব।

পড়ুনঃ  আমরা কি ভুল মহাবিশ্বে আছি ?

রহস্যময় প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আলী (রা.) বলেছিলেন, জাহান্নামের আগুন হলো সেই সত্তা যা হাত-পা ছাড়াই সবকিছু খায়। পানি হলো সর্বদা চলমান সত্তা। এক মুহূর্তে জন্মানো গাছ ছিল ইউনুস (আ.)-এর জন্য দানকৃত গাছ। জান্নাতের তুবা বৃক্ষের ছায়া চিরন্তন। উজাইর (আ.) ছিলেন সেই ব্যক্তি, যাঁর বয়স ছিল মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানের চেয়ে কম। আশহাবে কাহাফ ও তাঁদের কুকুর, উজাইর (আ.)-এর গাধা—এসব কিছুকেই আল্লাহ দুনিয়াতে আবার জীবন দিয়েছিলেন। কাক ছিল সেই নবীসম চরিত্র, যা কাবিলকে জানাজা শেখায়। এবং আল্লাহ আদম (আ.)-এর সৃষ্টির আগেই আত্মার জগতে সকল মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।

আলী (রা.) বলেছেন, “ফেরেশতারা স্বভাবজাতভাবে আল্লাহকে জানে, কিন্তু মানুষ আল্লাহকে চিনে জ্ঞানের মাধ্যমে।” এটাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।

হযরত আলী (রা.)-এর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর যুগের অনেক আগেই যুগান্তকারী ছিল। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান শেখেননি, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে এমন জ্ঞানের ঝর্ণাধারা দিয়েছিলেন, যা আজও মানুষকে বিস্মিত করে।

তাঁর জীবন আমাদের শিক্ষা দেয়, বিশ্বাস ও জ্ঞান কখনও একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বরং, তারা যখন একত্রে পথ চলে, তখনই সৃষ্টি হয় প্রকৃত মহত্ত্ব।

মহাবিশ্বের ‘মৃত্যুর দিন’ জানিয়ে দিলেন বিজ্ঞানীরা — পৃথিবীর জন্য সময় যেন এখন উল্টো দিকে চলছে

সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের সাহায্যে লন্ডনে বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত

আমরা কি ভুল মহাবিশ্বে আছি ?

জানুয়ারি-জুন ২০২৫: সাইবার সহিংসতার উদ্বেগজনক চিত্র প্রকাশ, দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান সিএসডব্লিউসি’র

মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন পোর্টসমাউথের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত

নির্ধারিত সময়ের আগেই ইরান থেকে চার মিলিয়ন আফগানকে দ্রুত বিতাড়ন

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি: ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে উদ্বেগজনক চিত্র

বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে প্রবাসীদের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে লন্ডনে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত