২৫ আষাঢ়, ১৪৩২, ৯ জুলাই, ২০২৫, ১৩ মহর্‌রম, ১৪৪৭

ইভানজেলিকালদের চাপে ট্রাম্পের ইরান যুদ্ধ: ধর্মীয় উন্মাদনা নাকি রাজনৈতিক কৌশল?

✍️ মতামত | কামাল সিকদার

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মিডিয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধের নেপথ্যের এক গভীর বাস্তবতা অনেকটাই আড়ালে থেকে গেছে: ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর ডানপন্থী খ্রিস্টান ইভানজেলিকালদের অসাধারণ প্রভাব।

অনেকেই ভেবেছিলেন এই যুদ্ধ হয়তো আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের অংশ। কেউ কেউ দেখেছেন এটি মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভর সংকটের প্রতিফলন। কিন্তু যেটা অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে, সেটা হল ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ইভানজেলিকাল মহলের ধর্মীয় উন্মাদনার চাপ। তাদের বিশ্বাস, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ যুগের (End Times) দ্বার খুলে দেবে — যীশু খ্রিস্টের প্রত্যাবর্তন অবশ্যম্ভাবী হবে।

টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার যেন এই জটিল বাস্তবতার একটা জানালা খুলে দিল। সাবেক ফক্স নিউজ সঞ্চালক টাকার কার্লসন যখন ক্রুজকে ইরান সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন করেন, তখন ক্রুজ এমনভাবে অজানা থেকে গেলেন যেন বিষয়টা তার ন্যূনতম ধারণার মধ্যেও ছিল না। কিন্তু তার অন্য একটি বক্তব্য ছিল আরও বেশি উদ্বেগজনক।

“আমি খ্রিস্টান হয়ে বড় হয়েছি,” বলেন ক্রুজ, “সানডে স্কুলে শিখেছি, যারা ইসরায়েলকে আশীর্বাদ করে তারা আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়, আর যারা অভিশাপ দেয়, তারা অভিশপ্ত হয়। আমি চাই আশীর্বাদের পক্ষে থাকতে।”

কার্লসন যুদ্ধবিরোধী হলেও, ক্রুজের এই বক্তব্যে প্রশ্ন তোলেননি। যেন আমেরিকার মত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নীতিতে খ্রিস্টীয় ধর্মতন্ত্রের আদর্শ মিশে যাওয়াটাই স্বাভাবিক! কিন্তু এই বক্তব্য হালকা করে দেখার মতো নয়। কারণ এই চিন্তাধারা ট্রাম্পের ইরান নীতির গভীরে প্রোথিত — যেখানে যুক্তি নয়, ধর্মীয় উন্মাদনাই মূল চালিকা শক্তি।

আমেরিকান সংবাদমাধ্যমগুলো ইরান ইস্যুতে মাগা (MAGA) আন্দোলনের ভেতরের বিতর্কগুলো বিশ্লেষণ করলেও, ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রভাব প্রায়শই অবহেলিত থেকেছে। অথচ, ডানপন্থী খ্রিস্টান নেতাদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প ঈশ্বরের প্রেরিত ব্যক্তি, যিনি পৃথিবীর শেষ যুগের সূচনা করবেন। তাদের মতে, ইরানে হামলা না করলে এই ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হবে না।

পড়ুনঃ  এমপিদের কাজ ও সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন

ধর্মতত্ত্ববিদ অ্যানথিয়া বাটলার ব্যাখ্যা করেছেন, ইভানজেলিকালরা বিশ্বাস করেন মধ্যপ্রাচ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ ছাড়া যীশুর প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। আর সেই যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইসরায়েলের ভূমি। টকিং পয়েন্টস মেমো-র সাংবাদিক সারা পোজনার দেখিয়েছেন, এই আন্দোলন মনে করে, বাইবেল অনুযায়ী, ইহুদিদের ইসরায়েলে ফিরে আসা এবং ইরানসহ বিদেশি শক্তির হামলা সবই অবশ্যম্ভাবী। বাইবেলে স্পষ্টতঃই বলা আছে শেষ জামানায় ইরানসহ পাচটি শক্তি ইসরাইলকে আক্রমন করবে। শেষ পর্যন্ত সেই যুদ্ধ হবে আরমাগেডনে — একটি রক্তক্ষয়ী, কিন্তু বিজয়ী যুদ্ধ। ইসলামেও এরকম একটি যুদ্ধের কথা বলা আছে যা মালহামাতুল কুবরা নামে পরিচিত।

এই বিশ্বাস আজ ইভানজেলিকালদের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করছে, সময় এসে গেছে। ‘শেষ যুগ’ সমাগত।

টনি পারকিন্স, যিনি ফ্যামিলি রিসার্চ কাউন্সিলের প্রধান এবং ট্রাম্প প্রশাসনের চরম ডানপন্থী প্রকল্প ‘প্রজেক্ট ২০২৫’-এর নেপথ্যের কারিগর, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধকে যীশুর প্রত্যাবর্তনের কৌশল হিসেবে খোলাখুলি প্রচার করছেন। ডানপন্থী পর্যবেক্ষক কাইল ম্যান্টিলা দেখিয়েছেন, কীভাবে পারকিন্স, প্রাক্তন কংগ্রেস সদস্য মিশেল বাচম্যান এবং মাগা পাদরি শেন ভন ‘ওয়ার্ল্ড প্রেয়ার নেটওয়ার্ক’-এ বারবার বলছেন, ট্রাম্পের বেঁচে যাওয়া (গত গ্রীষ্মের ব্যর্থ হত্যাচেষ্টা) নাকি ‘ঈশ্বরের পরিকল্পনার’ অংশ — যেন তাকে এই যুদ্ধ শুরু করার জন্যই রক্ষা করা হয়েছে।

“এটা রাজনীতি নয়, এটা আধ্যাত্মিক যুদ্ধ,” টুইট করেছেন প্রভাবশালী ইভানজেলিকাল নেতা ল্যান্স ওয়ালনাউ। “ইসরায়েলই শেষ যুগের মূল কেন্দ্রবিন্দু।”

এমনকি হোয়াইট হাউসের বাইরে এই ধর্মীয় গোষ্ঠী নাটকীয়ভাবে প্রকাশ্যে প্রার্থনা করে বলেছে, তারা এসথার রাণীর মতো — পারস্যের রাজাকে বিয়ে করে যিনি ইহুদিদের গণহত্যা থেকে রক্ষা করেছিলেন — এবং তারাও নাকি ‘এই সময়ের জন্য’ নির্বাচিত।

এখানে শুধু ধর্মীয় ভাষণ চলছে না, চলছে কৌশলগত রাজনৈতিক চাপ। ইভানজেলিকাল নেতারা ট্রাম্পকে বোঝাচ্ছেন, যেন তিনি তার যুদ্ধবিরোধী সহযোগীদের উপেক্ষা করেন। এমনকি ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত এবং দক্ষিণী ব্যাপটিস্ট মন্ত্রী মাইক হাকাবিও ট্রাম্পকে মেসেজ দিয়ে বলেছেন, “আপনি ঈশ্বরের নির্বাচিত ব্যক্তি।” ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলে জানা গেছে, তিনি প্রায়শই এইসব নেতাদের ‘প্রতারক’ বলে আড়ালে ঠাট্টা করেন, কিন্তু তারপরও তিনি নিজের সেই ‘নির্বাচিত’ পরিচয়টা ধরে রাখতে খুবই পছন্দ করেন।

পড়ুনঃ  মধ্যযুগঃ অন্ধকার নাকি আলোকিত

২০২৪ সালের নির্বাচন যতই তরুণ, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভোটারদের কেন্দ্র করে বিশ্লেষণ হোক না কেন, ট্রাম্পের প্রকৃত শক্তি ছিল ইভানজেলিকাল ভোটব্যাঙ্ক। নির্বাচনের হিসাব বলে, শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিকালদের ৮২% ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, যেখানে অন্যান্যদের মধ্যে ৫৮% ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কামালা হ্যারিসকে ভোট দিয়েছেন।

ইভানজেলিকালরা শুধু তার ভোটার নয়, তার আন্দোলনের সংগঠক, অর্থদাতা এবং নীতিনির্ধারক। তাদের ছাড়া ট্রাম্প কিছুই না।

ধর্মতত্ত্ববিদ বাটলার দেখিয়েছেন, কীভাবে ট্রাম্প এবং তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ইরানে বোমা হামলার ঘোষণায় ‘ঈশ্বরের নামে’ বক্তব্য রেখেছিলেন — স্পষ্টতই ইভানজেলিকালদের উদ্দেশ্যে। ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমরা তোমাকে ভালোবাসি ঈশ্বর, আমরা আমাদের মহান সেনাবাহিনীকে ভালোবাসি। ঈশ্বর মধ্যপ্রাচ্যকে আশীর্বাদ করুক, ঈশ্বর ইসরায়েলকে আশীর্বাদ করুক, ঈশ্বর আমেরিকাকে আশীর্বাদ করুক।”

হেগসেথ আরও এগিয়ে বলেছিলেন, “আমি ঈশ্বরকে গৌরব দিতে চাই। ঈশ্বর এই হামলাকে আশীর্বাদ করেছেন।”

এই বার্তা স্পষ্ট ছিল। ট্রাম্পের ‘আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা’ পলা হোয়াইট ভিডিও ক্লিপ ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করলেন। তার অনুসারীরা মন্তব্যে লিখল, ট্রাম্পই নাকি হোয়াইট হাউসে দেখা প্রথম ‘সত্যিকারের খ্রিস্টান’।

এদিকে, ট্রাম্পের যুদ্ধবিরোধী ঘনিষ্ঠ মহল তাকে চাপ দিতে থাকলেও তিনি আপাতত নিরাপদ। তিনি তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, ইরানে বোমা হামলা ছিল একবারের ঘটনা। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ ফিরিয়ে এনেছেন — যদিও তার যুদ্ধবিরতির ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েল এবং ইরান আবার বোমা বর্ষণ শুরু করে। ট্রাম্প এতটাই ক্ষুব্ধ হন যে লাইভ টিভিতে গালিও ছাড়েন।

তিনি এখনও ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একের পর এক অস্থির পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল: ট্রাম্প কি আসলেই এই যুদ্ধ থেকে সরে আসতে পারবেন? তিনি জানেন, ইভানজেলিকালদের তিনি হারাতে পারেন না। তাদের ছাড়া তিনি রাজনীতির মঞ্চে অচল।

আর ইভানজেলিকালদের সেই ‘শেষ যুগ’ নিয়ে উত্তেজনা এত তাড়াতাড়ি ফুরাবে না। তারা বিশ্বাস করে, তাদের প্রজন্মই যীশুর প্রত্যাবর্তন প্রত্যক্ষ করবে।

এমনকি ধর্মীয় নেতাদের জন্যও ‘শেষ যুগ’ এক দারুণ ব্যবসা। যতদিন না এই গল্পে তাদের প্রচুর অর্থ এবং খ্যাতি আসবে, ততদিন তারা ইরানের সঙ্গে বড় যুদ্ধের স্বপ্ন ছাড়বেন না।

পড়ুনঃ  মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে চরম মিথ্যাচার

কৃতজ্ঞতাঃ Salon.com এ প্রকাশিত আমান্ডা মারকোটের তথ্যানুসারে।

মহাবিশ্বের ‘মৃত্যুর দিন’ জানিয়ে দিলেন বিজ্ঞানীরা — পৃথিবীর জন্য সময় যেন এখন উল্টো দিকে চলছে

সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের সাহায্যে লন্ডনে বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত

আমরা কি ভুল মহাবিশ্বে আছি ?

জানুয়ারি-জুন ২০২৫: সাইবার সহিংসতার উদ্বেগজনক চিত্র প্রকাশ, দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান সিএসডব্লিউসি’র

মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন পোর্টসমাউথের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত

নির্ধারিত সময়ের আগেই ইরান থেকে চার মিলিয়ন আফগানকে দ্রুত বিতাড়ন

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি: ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে উদ্বেগজনক চিত্র

বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে প্রবাসীদের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে লন্ডনে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত