লন্ডনের প্রভাবশালী গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজে আজ অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, রোহিঙ্গা সংকট, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান এবং ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে খোলামেলা বক্তব্য দেন। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক কূটনীতিক, গণমাধ্যমকর্মী, গবেষক ও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা।
বক্তব্যের শুরুতেই অধ্যাপক ইউনূস স্পষ্টভাবে জানান, তার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গঠিত হয়নি, বরং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারার পুনঃপ্রতিষ্ঠাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। তিনি বলেন, “নির্বাচনের পর আমি সরে দাঁড়াব। ক্ষমতায় থাকার কোনো আগ্রহ বা উচ্চাশা আমার নেই।” তিনি আরও জানান, আগামী সাধারণ নির্বাচন ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬ এর মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে তারা নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাঠামোগত সংস্কারে কাজ করছেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মানবিক পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সংস্থা USAID চলে যাওয়ার পর খাদ্য সংকট মারাত্মক হয়েছে। তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে, এবং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সুযোগ নিচ্ছে। বিশ্ব যদি এখনই হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে এই সংকট বিস্ফোরণের দিকে যাবে।” তিনি উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা বাংলাদেশকে এ মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় সহযোগিতা করে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমরা জানি অর্থ কোথায় পাচার হয়েছে। দুবাই, মালয়েশিয়া এবং লন্ডনেও বহু অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, যার উৎস সন্দেহজনক। আমাদের সরকার এ অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করছে।” তিনি জানান, যুক্তরাজ্য সরকারকে সহযোগিতার অনুরোধ জানানো হয়েছে, যদিও নির্ধারিত সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে তার বৈঠক হয়নি।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা সবসময় ভারতের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক চেয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই এমন কিছু ঘটে যার ফলে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয় এবং বাংলাদেশের জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়, যা সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে।”
তিনি আরও জানান, তার চলমান ইউরোপ সফরের অংশ হিসেবে তিনি রাজা চার্লস তৃতীয়, যুক্তরাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। এ সফরের অন্যতম লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা। আগামী ১৩ জুন বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে তার এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে, যা দেশে একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের পথে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আলোচনার শেষে ইউনূস বলেন, “আমি সরকার চালাতে আসিনি। আমি এসেছি দেশকে সহায়তা করতে, যেন গণতন্ত্র ফিরে আসে। কাজ শেষ হলে আমি নীরবে সরে যাব।” চ্যাথাম হাউজে তার এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলে ইতোমধ্যেই গভীর আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের নীতিগত অবস্থান ও ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা স্পষ্ট করেছে।






